Nurul Islam Chowdhury

ব্রিটিশ আমলের দু’দু’বার পার্লামেন্ট সদস্য উপ-মহাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান জমিদার আমিরুলহজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর ১ম পুত্র তিনি। ১৯১৫ সালে পৈত্রিক বাড়ীতে তাঁর জন্ম। লেখাপড়া জীবন শেষ করে তিনি পিতার সহযোগী হিসেবে জমিদারী এষ্টেট পরিচালনার হাল ধরেন। সাথে সাথে বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত রাখেন । ১৯২২ সালে বৃটিশ সরকার পরীক্ষামূলকভাবে প্রতি মহকুমায় একটি করে ইউনিয়ন প্রথা চালু করেন। এর আগে থেকেই চালু ছিল গ্রাম পঞ্চায়েত ও থানা প্রশাসন (বর্তমান উপজেলা প্রশাসন) । দক্ষিণ চট্টগ্রামের মধ্যে ১ম বাঁশখালী থানার বৈলছড়ী ইউনিয়ন (বর্তমান কাথরিয়া ইউনিয়নসহ) চালু করা হয় । ৮টি গ্রাম নিয়ে তখনকার এ পরীক্ষামূলক ইউনিয়ন এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁরই পিতা খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী। তিনি ১৯২২ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকার পর তাঁর ১ম পুত্র নূরুল ইসলাম চৌধুরী ৫২ সাল থেকে একটানা ১৫ বছর প্রথমে প্রেসিডেন্ট পরে চেয়ারম্যান ছিলেন। তখনকার আমলে ইউনিয়ন পরিষদ স্থলে ইউনিয়ন বোর্ড এবং ইউনিয়ন প্রধানকে বর্তমান চেয়ারম্যান স্থলে প্রেসিডেন্ট বলা হতো । পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান সরকার এ নাম পরিবর্তন করেন।

১৫ বছর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে তিনি বৈলছড়ী ও কাথরিয়া ইউনিয়নের রাস্তা-ঘাট, সেতু, কালভার্টসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অবদান রাখেন। বিশেষ করে বর্তমান বৈলছড়ী ইউনিয়ন পরিষদ দালান তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল। তখনকার সরকার সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে পদক প্রদান করেন। ১৯৬২ সালের প্রথম দিকে তাঁর নিকটাত্মীয় ও বন্ধু সাহেব মিয়া চৌধুরী, আবদুল গণী চৌধুরী ও মাওলানা কবির আহমদ সহ হজ্বব্রত পালন উপলক্ষে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সফিনায়ে আরব (তখনকার সময়ে বিখ্যাত পানির জাহাজ) যোগে জেদ্দা রওনা হবার পর তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। তিনি হজ্ব ও যেয়ারত সমাপন করে দেশে ফিরে ছোট ভাই বোন ও সন্তান সন্ততির অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে জমিদারী এষ্টেট পরিচালনা করতে থাকেন। সাথে সাথে বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত রাখেন। বৈলছড়ী নজমুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সেক্রেটারী থেকে তিনি বিদ্যালয়ের উন্নয়নে অবদান রাখেন। বিশেষ করে বিজ্ঞান ভবন ও প্রশাসনিক ভবন তাঁরই প্রচেষ্টার ফসল। সংলগ্ন বৈলছড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দালানও তাঁরই প্রচেষ্টায় নির্মিত হয় । পাকিস্তান আমলে সরকারী মঞ্জুরীকৃত বেসরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি থাকতেন পদাধিকার বলে মহকুমা প্রশাসক এবং কমিটির সদস্য থেকে সেক্রেটারী নির্বাচিত হতেন ।

তিনি ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ভোটে জেলা পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হতো । তিনি জেলা পরিষদের একজন নির্বাচিত মেম্বার থেকে নিজেকে জেলার বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত রাখেন। তখন সাতকানিয়া-বাঁশখালী তথা গুনাগরী- কেরানী হাট সড়ক এবং চানপুর-টৈটং সড়ক জেলা পরিষদের আওতাধীনে ছিল । উভয় রাস্তার উন্নয়নে ও সেতু সংস্কারে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। বিশেষ করে বাঁশখালী-সাতকানিয়া সড়কের ডলু নদীর সেতুটি তাঁরই প্রচেষ্টায় নির্মিত হয় বলা চলে। পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কর্ণফুলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত কলেজ ছিল মাত্র ২টা । একটা সাতকানিয়া কলেজ অপরটি বোয়ালখালী কানুনগোপাড়া কলেজ। তিনি সাতকানিয়া কলেজের গভর্ণিং বডির সদস্য ছিলেন। বাঁশখালীর বহু ছেলেমেয়ে তখন সাতকানিয়া কলেজে লেখাপড়া করতো। তন্মধ্যে তাঁর ছোটভাই, ছেলে, নিকটাত্মীয়রাও ছিল। তখনকার সময়ে সাতকানিয়া কলেজের উন্নয়নে তাঁর অবদান স্মরণ রাখার মত ।

পাকিস্তান আমলে হজ্ব করা যেমন কঠিন ছিল তেমনি হজ্বের নিয়ম কানুন জানাও ছিল দুরূহ। তখন তিনি হজ্বযাত্রীগণের সেবায় হস্ত সম্প্রসারিত করেন। চট্টগ্রাম শহরের মিয়া খান নগরস্থ বাসা বাড়ীতে হজ্ব যাত্রীদের রাখতেন এবং নিজের জীপ দ্বারা হজ্বযাত্রীগণকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছিয়ে দিতেন। তখন পানির জাহাজে করে হজ্ব করা ছিল হজ্বে গমনের প্রধান মাধ্যম। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বার্ধক্যজনিত রোগে ১৯৮৯ সালের রমজান মাসের ৯ তারিখে বাঁশখালীর বৈলছড়ী গ্রামের বাড়ীতে তিনি ইন্তেকাল করেন । নামাজে জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয় । 

                                         –  মরহুমের ভাই লেখক আহমদুল ইসলাম চৌধুরী কর্তৃক লিখিত 2000 ইংরেজি সালের প্রবন্ধ অবলম্বনে