
Dr. Sirajul Islam Chowdhury
Son of Khan Shaheb Rafique Ahmed Chowdhury
Dr. Sirajul Islam Chowdhury
Son of Khan Shaheb Rafique Ahmed Chowdhury
১১ জানুয়ারি ২০২১
ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
আহমদুল ইসলাম চৌধুরী কালান্তরে দৃষ্টিপাত
ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকায় ১৯৪৬ সালে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর পর এমবিবিএস এ ভর্তি হন ও ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল; আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। ঢাকা মহাখালীতে কর্মরত ছিলেন চীফ কেমিক্যাল এক্সামিনার হিসেবে। ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯২৫ সালে ১১ মার্চ বাঁশখালী বুনিয়াদি পরিবার খান বাহাদুর বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলহাজ্ব খান সাহেব রফিক আহমদ চৌধুরী। পিতারা ৩ ভ্রাতা। পিতার বড় ভ্রাতা আমিরুল হজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী। পিতার ছোট ভ্রাতা আলহাজ্ব কাজী আজিজ আহমদ চৌধুরী।
ডা. সাহেবের পিতা রফিক আহমদ চৌধুরী ব্রিটিশ ভারতে বনবিভাগে মুসলমানগণের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা (কনজারভেটর অব ফরেস্ট) হিসেবে অবসরে যান। তিনি ১৯৩৫ সালে বড় ভাই খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর সাথে মুম্বাই হয়ে হজে গমন করেন। সাথে আরও ছিলেন আনোয়ারা প্রখ্যাত জমিদার এয়ার আলী খান (এমএনএ) সহ কয়েকজন। বড় ভাই খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী সেই সময় ২য় বার ব্রিটিশ ভারতে আমিরুল হজ হিসেবে হজে গমন করেছিলেন। ডা. সাহেবের পিতা আলহাজ রফিক আহমদ চৌধুরীকে ব্রিটিশ সরকার সততা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি স্বরূপ খান সাহেব উপাধিতে ভূষিত করেন। তেমনিভাবে পিতার যোগ্য পুত্র ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও সততার উজ্জল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। বাঁশখালী গ্রামের বাড়ীর সম্মুখস্ত জুনিয়র মাদ্রাসা থেকে প্রাথমিক ডিগ্রী লাভ করেন।
বেঙ্গল এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের অধীনে ১৯৩৬ সালে। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক (ম্যাট্রিকুলেশন) পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন করে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন । ১৯৫৫ সালে দাম্পত্য জীবনে পা বাড়ান। চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব আবু সৈয়দ দু'ভাষীর কন্যা মাসুমা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আবু সৈয়দ দু’ভাষ বুনিয়াদী পরিবারের যোগ্য পাত্র পেয়ে খোলা মনে ব্যয় করে রাজসিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। আজও এ মহানগরের বয়স্কগণের মুখ থেকে এ বিয়ে অনুষ্ঠানের কথা শত ভাগ হারিয়ে যায়নি। ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এমবিবিএস পাস করার পর বাঁশখালী গ্রামের বাড়ীতে রোগী দেখাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত অবস্থায়ও অনেক নারী পুরুষ সমাগম হত রোগী হিসেবে । ফি ত নিতেনই না, বরং শহর থেকে ঔষধ নিয়ে যেতেন। বাঁশখালীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসত এ খান বাহাদুর বাড়ীতে তাকে এক নজর দেখার। অফিসের গাড়িটি প্রায় নষ্ট থাকে। ফলে বাসা থেকে হেঁটে নিউমার্কেট; তথা হতে সাধারণযাত্রীদের সাথে টেম্পু করে তেজগাঁও যেতেন। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বা রিক্সায় অফিসে যেতেন। গাড়ি খারাপ থাকলে এভাবে তার যাওয়া আসা হত। যা ১৯৭২- ১৯৭৮ সালের দিকের ঘটনা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মহাখালীতে চীফ কেমিক্যাল এক্সামিনার হিসেবে থাকাকালীন লোকজন ঘুরঘুর করত ঘুষ দেয়ার জন্য। যেহেতু দেশের পোস্টমোর্টেম রিপোর্ট তাঁর স্বাক্ষরেই হবে। এতে রিপোর্ট যাতে পক্ষে আনা যায় সে লক্ষে ঘুষ দেয়ার প্রচেষ্টা চালাত অসাধু লোকজন। আমাদের দেশে অফিস আদালতে ঘুষ দুর্নীতিতে বড় কর্তার গোপন নির্দেশে অধীনস্তরা ভূমিকা পালন করে। ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ ক্ষেত্রে ঘুষ ত নয়ই অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী কঠোর নিয়ম নীতির কারণে ভীত তটস্ত থাকত। যেহেতু সরকারী নিয়ম শৃংখলার ন্যূনতম কোন অনিয়ম হচ্ছে কি না তিনি খেয়াল রাখতেন। সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা তার অন্যতম আদর্শ। সময় মেনে অফিসে যাওয়া আসার পাশাপাশি অফিস স্টেশনারীসহ যাবতীয় কিছুতে বেশি খরচ বা অপব্যয় হচ্ছে কি না তাও তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। একাধিক বার দেখা গেছে অফিসে সুবিধা করতে না পেরে অনেক দুঃসাহসী লোক আজিমপুর তার বাসায় দেখার লক্ষে বাহির থেকে ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেল টিপত।
যেহেতু তখন এমবিবিএস ডাক্তারত নয়-ই এলএমএফ ডাক্তারেরও সীমাবদ্ধতা ছিল। ডা. সাহেব করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে এমফিল ডিগ্রী নেন। ১৯৬৭ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচপি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ঢাকা মহাখালীতে দেশের চীফ কেমিক্যাল এক্সামিনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। থাকতেন তথায় সরকারী কোয়ার্টারে। আমেরিকা থেকে আসবার সময় একটি ভক্সওয়াগণ কার নিয়ে আসেন; নিজে চালাতেন। তখন মহাখালী অনেকটা গ্রামাঞ্চল বলা যাবে। যেহেতু তেজগাঁও বিমান বন্দরের পর ঢাকা শহর ঐদিকে তথা উত্তর দিকে সম্প্রসারণ পর্যায়ে। সন্তানেরা বড় হলে লেখাপড়ার সুবিধার জন্য তিনি আজিমপুর ইডেন কলেজের বিপরীতে সরকারী কোয়ার্টারে চলে আসেন। সরকারী বেতনে সন্তান-সন্ততি নিয়ে কষ্ট হচ্ছিল। খরচ সামলাতে সুন্দর জীবন যাপন করতে নিজের আনা গাড়িটি বিক্রি করে দেন। অন্যদিকে কোন লোক তার বাসায় প্রবেশ করার সুযোগ পেত না । কড়া ভাষায় চলে যেতে বলে দরজা বন্ধ করে দিতেন। তাঁর সততা এবং বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে পেরে উঠত না। বেতনে জীবন প্রবাহ কষ্টসাধ্য হচ্ছিল বিধায় ১৯৭৮ সালে সরকারী চাকুরী থেকে পদত্যাগ করে ইরাক চলে যান ডা. হিসেবে উচ্চপদে অফার পেয়ে। যোগদান করেন কুফা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় দেশে ফিরে আসেন। তা সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা সৌদি দূতাবাস জানতে পেরে দেশে আসার ক'দিনের ব্যবধানে রিয়াদে বড় চাকুরীর অফার দেন। রিয়াদ বাদশাহ খালেদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে উচ্চপদে যোগদান করেন।
রাজপরিবারের একাধিক সদস্য তার ছাত্র ছিল। ইরাকের পাশাপাশি সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাকে অতি মূল্যায়ন করত। চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও এ ব্লকে সিডিএর একটি প্লট বরাদ্ধ পান। সৌদি আরব থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে একটি দালান নির্মাণ করেন এ প্লটে। বয়সের ছাপ এসে গেলে স্বেচ্ছায় রিয়াদ থেকে চট্টগ্রাম চলে আসেন। তার দালানের নিচতলায় এবং বাঁশখালী গ্রামের বাড়ীতে আগের মত রোগী দেখা শুরু করেন বিনা পয়সায়। যা তার ইন্তেকাল পর্যন্ত ছিল। পিতা আলহাজ্ব খান সাহেব রফিক আহমদ চৌধুরীর ৫ পুত্র, ৪ কন্যা। তত্নধ্যে ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ২য়। ডা. সাহেবের ছোট বোন বেগম নুরুন নাহার। স্বামী আনোয়ারা বরুমচড়া সম্ভ্রান্ত পরিবারের জান আলী চৌধুরীর পুত্র আবু তালেব চৌধুরী। শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত ছিলেন। অতিরিক্তি পরিচালক থেকে অবসরে যান। তিনিও সততার সাথে জীবন কাটিয়ে ছিলেন। মতিঝিল সরকারী কোয়ার্টারে চাকুরীর বড় সময় কাটান। ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ২য় বোন বেগম কামরুন নাহার জাফর। একাধিক বার এমপি ও একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। বৃহত্তর চট্টগ্রামে আজও তিনি ছাড়া মহিলাদের মধ্যে আর কেউ মন্ত্রী হননি। তাঁর স্বামী রাউজানের প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডা. আবু জাফর। ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ছোট ভাই শহীদ ফরহাদ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কক্সবাজারে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। তার মূল নাম ফরহাদ্দৌল্লাহ মোহাম্মদ এজহারুল ইসলাম চৌধুরী হলেও শহীদ ফরহাদ হিসেবে এখনও সকলের মাঝে জাগরুক। ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত শহরের বাসায় ও বাঁশখালী গ্রামের বাড়ীতে বিনা ফিতে রোগী দেখা অব্যাহত রাখেন। চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানকালীন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম এর আবদার অনুরোধ রক্ষার্থে ইউএসটিসিতে ক্লাস নিতেন। ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন । ইন্তেকালের সময় তিনি স্ত্রী, ২ পুত্র, ৪ কন্যা রেখে যান। তার স্ত্রীও ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে ইন্তেকাল করেন । আলহাজ্ব ডা. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন সততার উজ্জল দৃষ্টান্ত। যা আমাদের দেশের ডা. সমাজ, সাথে সাথে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীগণের জন্য অনুকরণীয় বলে মনে করি।
